শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

একটাই পৃথিবী : প্রকৃতির  ঐকতানে টেকসই জীবন

 মো: আরাফাত রহমান

৫ জুন ছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ২০২২ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য “একটাই পৃথিবী: প্রকৃতির ঐকতানে টেকসই জীবন”। পরিবেশ বলতে কোনো ব্যবস্থার ওপর কার্যকর বাহ্যিক প্রভাবকসমূহের সমষ্টিকে বোঝায়। চারপাশের ভৌত অবস্থা, জলবায়ু ও প্রভাব বিস্তারকারী অন্যান্য জীব ও জৈব উপাদান ইত্যাদির সামষ্টিক রূপই হলো পরিবেশ। পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের দ্বারাই একজন ব্যক্তি বা প্রাণী এমনকি উদ্ভিদ প্রভাবিত হয়ে থাকে। 

এই প্রভাবকসমূহের মধ্যে থাকে প্রাকৃতিক এবং অপ্রাকৃতিক বা কৃত্রিম পারিপার্শ্বিক উপাদানসমূহ। বিশ্ব পরিবেশ দিবস প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতার মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার লক্ষে পালিত দিবস। এই দিনটিতেই জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ কনফারেন্স হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন অবধি। তখন থেকেই প্রতি বৎসর এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি প্রথম পালিত হয় ১৯৭৪ সালে।

১৯৬৮ সালের ২০ মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায় সুইডেন সরকার। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা। সে বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরের বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি ইতিহাসের প্রথম পরিবেশ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ জুনকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।

পরিবেশের উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে গাছ-পালা, নদী-নালা, খাল-বিল, রাস্ত-ঘাট, ঘর-বাড়ি, পানি, সূর্য, মাটি, বায়ু, নৌকা, পশু-পাখি, বিদ্যালয়, দালান-কোঠা ইত্যাদি তথা আমাদের চারপাশের সকল কিছুই পরিবেশের অংশ। প্রাকৃতিক পরিবেশ হচ্ছে সেই পরিবেশ যা প্রকৃতি নির্ধারিত। এগুলো হচ্ছে গাছ, পাহাড়-পর্বত, ঝরনা, নদী ইত্যাদি। এগুলো প্রাকৃতিক ভাবেই সৃষ্টি হয়। মানুষের তৈরি পরিবেশ হচ্ছে নগরায়ন, বন্দর ইত্যাদি। এগুলো মানুষ নিজের প্রয়োজনের তাগিদে তৈরি করে। পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সুসমন্বিত রূপই হলো সুস্থ পরিবেশ। এই সুসমন্বিত রূপের ব্যত্যয়ই পরিবেশের দূষণ ঘটায় এবং পরিবেশের স্বাভাবিক মাত্রার অবক্ষয় দেখা দেয়। 

পরিবেশ বিভিন্ন কারণে দূষিত হতে পারে। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণও এর সাথে দায়ী। পরিবেশ দূষণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ১২টি মারাত্মক রাসায়নিক উপাদানকে একত্রে “ডার্টি ডজন” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এদের মধ্যে ৮টি কীটনাশক অলড্রিন, ডায়েলড্রিন, ক্লোরডেন, এনড্রিন, হেপ্টাক্লোর, ডিডিটি, মিরেক্স, এবং টক্সাফেন; দুটি শিল্পজাত পিসিবি এবং হেক্সাক্লোরোবেনজিন; এবং অন্য দুটো হলো কারখানায় উৎপন্ন অনাকাক্সিক্ষত উপজাত: ডাইওক্সিন এবং ফিউরান। খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে পৃথিবীব্যাপী সব পরিবেশের সব ধরনের জীবজন্তুর উপর তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটায় এই বিষাক্ত পদার্থগুলো। 

গত তিন দশকে বনজ বৃক্ষের পরিমাণ ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। কৃষিজমির প্রসার এবং বনজ দ্রব্যের বর্ধিত চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক বনভূমি অবৈধভাবে ফসলি জমিতে পরিণত করা হয়েছে। যদিও বন সম্পর্কিত হালনাগাদ পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। সত্তরের দশক থেকে বনভূমির পরিমাণ শতকরা ৫০ ভাগেরও অধিক হ্রাস পেয়েছে। ১৯৭০ সালে মধুপুর অঞ্চলে ২০,০০০ একরেরও অধিক শালবন ছিল; বিশ বছর পর অবশিষ্ট থাকে আনুমানিক ১,০০০ একর। ১৯৯০ সালের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে মাথাপিছু বনের পরিমাণ ০.০২ হেক্টরেরও কম যা বিশ্বে জনসংখ্যা অনুপাতে সর্বনি¤œ বনের পরিমাণগুলির একটি।

বাংলাদেশের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে বন ও জলাভূমি এলাকায়। আনুমানিক ৫,০০০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এদেশে বাস করছে ২৬৬ ধরনের স্বাদুপানির ও ৪৪২ ধরনের সামুদ্রিক মাছ, ২২ উভচর, ১০৯ অভ্যন্তরীণ ও ১৭ সামুদ্রিক সরীসৃপ, ৩৮৮ স্থায়ী ও ২৪০ পরিযায়ী পাখি, ১১০ অভ্যন্তরীণ ও ৩ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। কিছু প্রজাতিকে হুমকির সম্মুখীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের জানা মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে ১৩টি সম্প্রতি এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ মৎস্য প্রজাতিসমূহের মধ্যে ৫৪টি হুমকির সম্মুখীন। বিপন্ন উভচর, অভ্যন্তরীণ সরীসৃপ, স্থায়ী পাখি ও অভ্যন্তরীণ স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রজাতি সংখ্যা যথাক্রমে ৮, ৫৮, ৪১ ও ৪০। 

জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হওয়ার প্রধান কারণসমূহ হল-মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে প্রাণীর বিচরণ পথ ও জলাভূমি আবাসস্থলের ক্ষতি; কৃষি, বাসস্থান ও বাণিজ্যিক উদ্দেশে মানুষের বনভূমি দখল; জ্বালানি ও নির্মাণের জন্য নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ হ্রাস; কতিপয় বনজসম্পদ যেমন ভেষজ উদ্ভিদ, বাঁশ ও বেতের অতিরিক্ত আহরণের ফলে রক্ষামূলক বাসস্থান লোপ; অতিরিক্ত বন্যপ্রাণী শিকার; উফশী জাতসমূহের একক চাষ, বা বহুমুখী শস্য চাষ হ্রাস পাওয়ায় কৃষি রাসায়নিক দ্রব্যসমূহের ব্যবহার বৃদ্ধি; ম্যানগ্রোভ বন উজাড় এবং জুমচাষ।

পরিবেশ কার্যক্রমের দেশের সকল ভৌগোলিক অঞ্চল ও উন্নয়নখাতে বিস্তার হয়েছে। তদনুযায়ী পরিবেশনীতির সামগ্রিক লক্ষ্যসমূহ অর্জনে গৃহীত বিভিন্ন কর্মকৌশলে ১৫টি খাত অন্তর্ভুক্ত হয়েছে: কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন, শক্তি ও জ্বালানি, পানিসম্পদ উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ, ভূমি, বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য, মৎস্য ও পশুসম্পদ, খাদ্য, উপকূলীয় ও সামুদিক পরিবেশ, পরিবহণ ও যোগাযোগ, গৃহায়ণ ও নগরায়ণ, জনসংখ্যা, শিক্ষা ও জনসচেতনতা, এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গবেষণা। পরিবেশনীতির ৪নং অনুচ্ছেদে রয়েছে আইনগত রূপরেখা যাতে বর্তমান সময়ের চাহিদা পূরণের লক্ষে পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কিত নতুন আইন প্রণয়ন এবং সকল আইন ও বিধান সংশোধন, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং পরিবেশ দূষণ ও অবক্ষয়রোধ প্রভৃতি বিষয় শর্তাবদ্ধ হয়েছে। 

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পরিবেশ সুরক্ষা বাংলাদেশ সরকারের একটি অগ্রাধিকারী বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শহুরে ও গ্রামীণ পরিবেশের দ্রুত অবক্ষয় নিয়ে সরকার ও সুশীল সমাজের উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেবল একটি সুষ্ঠু জাতীয় নীতির মাধ্যমেই পরিবেশের প্রতি সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং পরিবেশ সম্পর্কিত অন্যান্য সমস্যা সমাধান সম্ভব। সরকার পরিবেশ নীতি গ্রহণসহ বেশকিছু নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে। পরিবেশনীতির লক্ষ্যসমূহ হলো: পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে বাস্তুসংস্থানিক ভারসাম্য ও সার্বিক উন্নয়ন সুরক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দেশকে রক্ষা, পরিবেশ দূষক ও ক্ষতিকারক কর্মকান্ড শনাক্তকরণ ও নিয়ন্ত্রণ, সকল খাতে পরিবেশসম্মত উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ, সকল জাতীয় সম্পদের টেকসই, দীর্ঘমেয়াদি ও পরিবেশ অনুকূল ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং পরিবেশ সম্পর্কিত সকল আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সঙ্গে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রায় কার্যকর সংযোগ রক্ষা। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ